প্রতি বছরের মতো এবারও দুর্গোৎসব ঘিরে দেশব্যাপী আনন্দ-উৎসবের ফল্লুধারা থাকলেও দেশব্যাপী কোটাবিরোধী আন্দোলনের প্রভাব এর ওপর পড়েছে। আসন্ন দুর্গাপূজায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে মাঠ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য একগুচ্ছ নির্দেশনা জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
স্মারকে বলা হয়েছে- (ক) শারদীয় দুর্গাপূজা-২০২৪ উদযাপন উপলক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ, র্যাব এবং আনসার ও ভিডিপি কর্তৃক দৃশ্যমান টহল জোরদার এবং গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মাঠে নিয়োজিত স্বশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবে। (খ) যে কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা প্রতিরোধে পূর্বপ্রস্ততি গ্রহণ করতে হবে।
অপ্রত্যাশিতভাবে কোনো ঘটনার সূত্রপাত ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই সংশিষ্ট সবাইকে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; (গ) শারদীয় দুর্গাপূজা-২০২৪ উদ্যাপন উপলক্ষ্য স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে পুজামন্ডপসমূহ পরিদর্শন করতে হবে; (ঘ) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপতিকর বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে, এরূপ কোনো বক্তব্য বা গুজব ছড়ানোর বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে: (ঙ) সংশ্লিষ্ট পূজা উদযাপন কমিটিসমূহকে পূজামণ্ডপসমূহে সার্বক্ষণিক পাহারার জন্য প্রয়োজনীয়-সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক ও পাহারাদার (পালাক্রমে দিনে কমপক্ষে তিন জন এবং রাতে চার জন) নিয়োজিত করতে হবে; (চ) প্রতিটি পূজামপে সার্বক্ষণিক সিসি ক্যামেরা স্থাপনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে: (ছ) শারদীয় দুর্গাপূজা-২০২৪ উদ্যাপন উপলক্ষ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে পুলিশ বাহিনীর সদস্য, বিজিবি, আনসার ও ভিডিপি, র্যাব এবং অন্যান্য বাহিনীর সদস্য মোতায়েন নিশ্চিত করতে হবে; (জ) শারদীয় দু্গাপূজা-২০২৪ উপলক্ষ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি পূজামগুপের নিরাপত্তা বিধানে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও ছাত্র-জনতাকে অন্তর্ভুক্ত করে মনিটরিং কমিটি গঠন করতে হবে।
জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসকরা এবং উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা এরূপ কমিটি গঠন করবেন। তা ছাড়াও শারদীয় দুর্গাপূজাকে আনন্দঘন পরিবেশে নিরাপদে উদযাপনের লক্ষ্যে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ৮৪ হাজার কর্মীবাহিনী স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ।
৪ থেকে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত তারা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে ৩২ হাজার পূজামণ্ডপে কাজ করবেন। উপদেষ্টা শারমীন এস সুরশিদ বলেন, ‘প্রতিদিন সব কর্মকর্তা/কর্মচারীকে পূজামণ্ডপ অনুসারে আট ঘণ্টা করে তিন শিফটে রোস্টার দায়িত্ব দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সব দপ্তর-সংস্থাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পুলিশের সঙ্গেও নাগরিক সমাজ, বিপ্লবী ছাত্ররাও থাকবেন।
তিনি বলেন, আমরা মুসলমান, হিন্দু খ্রিষ্টান বা বৌদ্ধ বলে বিভেদ সৃষ্টি করতে দিতে পারি না। আমরা পূজামণ্ডপগুলো নজরদারি করব। যদিও সব মন্ত্রণালয় ব্যাপক নজরদারি করছে।
সার্বিক সহযোগিতা দিতে সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন প্রকল্পে কর্মরত/দায়িতরত কর্মকর্তা/কর্মচারীরা পূজামণ্ডপের দায়িত্বে থাকবেন। তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয়ভাবে একটি কন্টোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। সারা দেশের পূজামন্ডপ মনিটরিং রিপোর্ট এই কট্রোল রুমে সরবরাহ করা হবে (কন্ট্রোল রুমের যোগাযোগ নম্বর: ১০৯৮)।
এছাড়াও সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর/সংস্থার সদর কার্যালয়ে কন্ট্রোল রুম স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা ৪ থেকে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত চালু থাকবে৷ সেই সঙ্গে কর্মকর্তা/কর্মচারীর (সনাতন ধর্মের কর্মকর্তা/কর্মচারী ব্যতীত) পূজার সময়ে ছুটি বাতিল করার জন্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সব দপ্তর/সংস্থাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ঢাকাসহ কিছু জায়গায় পূজামণ্ডপে হামলা হয়েছে। যারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের আটক করেছে। আমাদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। দুষ্কৃতিকারীরা নানা কুট্চালে আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চাইছে। কিন্তু তা হতে দেওয়া যাবে না। আমাদের সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে।
এবারের দুর্গাপূজা পড়েছে আশ্বিন মাসে, যা শরৎকাল নামে পরিচিত এবং বন্যার কারণে অনেক সাদাসিধেভাবে পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, থাকবে না কোনো মেলা বা শোভাযাত্রা, যার ফলে সাশ্রয়ী অর্থ মানবতার সেবায় গরিবদের মধ্যে বিতরণ করা হবে বলে সর্বজনীন পূজা উদ্যাপন কমিটি জানিয়েছে।
এই শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব হলেও এখন সেটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। কথায় বলে, ধর্ম যার যার উৎসব সবার ।’ এই ধারণায় বাংলাদেশের সব বাঙালি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এর আমেজ আনন্দ উপভোগ করে আসছে কালান্তরে৷
বাংলাদেশে দুর্গাপূজা মণ্ডপগুলোতে মহাসপ্তমী থেকে মহাদশমী পর্যন্ত বিপুল পূজারীর সমাগম হয়। বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন কমিটি ও ঢাকা মহানগর পূজা উদ্যাপন কমিটি সার্বিক বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করে থাকে।
দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা খুবই জটিল, যা পণ্ডিত ও তার সহযোগীদের দ্বারা পরিচালিত হয়। যেমন- মনহাসপ্তমীতে পুজারম্ব, অঞ্জলি প্রদান, প্রসাদ বিতরণ, সন্ধ্যা-আরতি: মহাষ্টমীতে সন্ধিপূজা, কুমারীপুজা (রামকৃষ্ণ মিশন মঠ), অঞ্জলি প্রদান, প্রসাদ বিতরণ, সন্ধ্যা-আরতি; মহানবমী পূজারম্ভ, অঞ্জলি প্রদান, চণ্ডীপাঠ, সন্ধ্যা-আরতি এবং সবশেষ বিজয়া দশমী পুজারম্ভ, দর্পণ বিসর্জন, ও শান্তির জল গ্রহণ, সিঁদুর পরানো ও প্রতিমা বিসর্জন। দুর্গাপূজার ধর্মীয় আচরণের মধ্যে রয়েছে- ভক্তিমূলক গান, ভজন, যাত্রাপালা, লক্ষী বিলাস, নৌকা বিলাস, নিমাই সন্ন্যাস ইত্যাদি।
এদের আয়োজনটি সূচনা হয় দুর্গাপূজার সময় থেকে আর শেষ হয় পহেলা বৈশাখের (১৪ এপ্রিল) অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। এমনিতেই এই যাত্রাশিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বলয়ে এই পূজার গুরুত্ব অপরিসীম।
প্রতি বছরই এই দিনটির জন্য ব্যবসায়ীরা অপেক্ষা করে থাকেন যা দেশের সংস্কৃতি ব্যবসায়-বাণিজ্য সামাজিক উন্নয়নের এক অপূরব-নিদর্শন। ঢাকা শহরের পূজামপগুলোর মধ্যে ঢাকেশ্বরী মন্দির ও রামকৃষ্ণ, বনানী কলাবাগান সর্বজনীন পূজামণ্ডপ, সনাতন সমাজ কল্যাণ সংঘ পুজামণ্ডপ খামার বাড়ী,শীখারী বাজার পুজামণ্ডপ উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের মতে, এবার সারাদেশে প্রায় ৩২ হাজারের মতো পৃজামণ্ডপ স্থাপিত হতে পারে, যার মধ্যে রাজধানী ঢাকাতে মণ্ডপের সংখ্যা ২৩৪টি ৷
পুরান ঢাকার লালবাগ থানার ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির কর্তৃপক্ষ করোনা মহামারির কারণে সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে পাঁচ দিনে সীমিত আকারে কর্মসূচি ঘোষণ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ভক্তিমূলক গান পরিবেশন, গরিবদের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ, মহাপ্রসাদ বিতরণ, আরতি প্রতিযোগিতা, স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি ও বিজয়া দশমীর পর্ব।
বাংলাদেশের পুজার জগৎ অনেকটা পারিবারিক গণ্ডি পেরিয়ে এখন দেশে কিংবা বিদেশে বিস্তৃতি ঘটেছে। বিশেষত যেখানে বাংলা ভাষাভাষীরা আছে, যেমন- অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারতে।
উৎসবের আমেজ যত বাড়ে, ততই ব্যাপ্ত হয় আনন্দের সীমানা। পূজার মৌসুমে অনেকেই দেশে আসে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে পূজা উদ্যাপন করতে এবং আশা করা যায়, আগামী দিনে এক অসাম্প্রদায়িক বংলাদেশ গড়তে শারদীয় দুর্গোৎসব বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক